আমেরিকান সৈন্য মধ্যপ্রাচ্যে অর্থাৎ আরব উপদ্বীপে আসার জন্য কে দায়ী?

উপসাগরীয় যুদ্ধ: জেনারেল সাদ্দামের কুয়েত দখল ও সৌদি ভূখণ্ডে মার্কিন সেনা ফ্যাক্ট: পর্ব ২

যুদ্ধ শেষে সৌদি ও কুয়েতি নাগরিকদের উল্লাস

আরবে মার্কিন প্রভাব মূলত সমালোচকরা ধরে নেয় যে সৌদি আরবই তাদেরকে সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে “সুযোগ করে দেয়” কথাটি এমন না হয়ে হবে “সুযোগ করে দিতে বাধ্য করা হয়”। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে জেনারেল সাদ্দামের অতি বাড়াবাড়ি ও আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান না করে হুটহাট কর্মকাণ্ডের ফলেই ১৯৯০ শুরুই হয় যুদ্ধ দিয়ে। আর এটাই হয়ে উঠেছিল মার্কিনীদের জন্য ‘The key point of entrance in the Middle East’। যা মার্কিনিদের সুযোগ করে দেয় মধ্যপ্রাচ্যে পা রাখার।

কিন্তু সমালোচকরা ‘জানে না যা তারা জানতো’ সমালোচকারা একদল ‘নির্দিষ্ট মতের অনুসারীদের’ যাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে পানিকে দূষিত করে স্বার্থ হাসিল করা। তাদেরই লেজ ধরে জন্ম নিয়েছে একদল মর্ডান সমালোচক গুষ্টি যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে ফেসবুকের আর ইউটিউবের দু চারটা অপশন ক্লিক করা। তারা যুগের যুগের পর যুগ মনগড়া তত্ত্বের জন্ম দেওয়া। কিন্তু তারা কি সেইসব বাদশাদের টনক নাড়াতে পেরেছিল? “না” পারেনি কারণ সেইসব বাদশারা ইদুরদের প্রশ্রয় দেন না তবে তাদের গুরুদের অর্থাৎ সেই সব কালসাপদের একের পর এক উপ্রে দিয়ে সামনে এগিয়েছেন। আর যুগের পর যুগ সেইসব বাদশারা আরবে থাকা আরব ও নন-আরবদের শাসন করে গেছেন আজও করছেন আগামীতেও করবেন (ইনশাআল্লাহ)। এবং তাদের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অশেষ সাহায্যে রক্ষা করে গেছেন ভূমিতে থাকা জনগণের। রক্ষা করেছেন ভবিষ্যত ও আগাম প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন এক নিরাপদ ভূমি।

‘The key of entrance in the Middle East for America’ যেটি ছিল আলোচনার বিষয়। কিন্তু কিভাবে?
কিভাবে সেটার উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে লম্বা আলোচনায় আর ফিরে যেতে ১৯৯০ এর আগের বছরগলোতে। প্রয়াত বাদশা ফায়সাল বিন আব্দুল আজিজ (রাঃ) ১৯৬৪-১৯৭৫, প্রয়াত বাদশা খালিদ বিন আব্দুল আজিজ (রাঃ) এর শাসনামলের সময় ১৯৭৫-১৯৮২ ও পরবর্তীতে প্রয়াত বাদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ (রাঃ) শাসনামল ১৯৮২-২০০৫।

সৌদি-ইরান সম্পর্কের টানাপোড়ন আজকের নতুন নয়। বরং ৮০’র দশক থেকেই সৌদি আরব সবসময়ই ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ দেখে আসছে। জার ফলশ্রুতিতে সৌদি আরব ইরাককে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।

৮৭ বছর আগে ১৯৩৩ সালে SOCAL (বর্তমান ARAMCO) প্রতিষ্ঠিত করবার পর ১৯৩৮ সালে সৌদি আরবে তেল আবিষ্কৃত হয়, সেই থেকে আয়তনে পশ্চিম এশিয়ার ও মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম দেশ সৌদি আরব দ্রুত একটি অত‍্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে বেশ সম্পদশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্রটির আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার পরিমাণ অত্যন্ত কম। এবং সৌদি রাজপরিার অর্থাৎ বাদশারা সবসমই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করতো। এবং সেই আশঙ্কা অবশেষে সত্য হয় প্রয়াত বাদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজের শাসনামলে।

সে সময় সৌদি আরব একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র হবার পরেও প্রতিরক্ষা খাতে বেশ দুর্বলতা অনুভব করেন বাদশা খালিদ (রঃ) ও পরবর্তীতে বদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ (রঃ)। আর তাই ১৯৮০ এর দশকে সৌদি আরব ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা এরও বেশী ব‍্যয়ে একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তোলে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর তাদের বৈদেশিক সদর দপ্তর তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি থেকে সৌদি আরবে স্থানান্তরিত করে। তারা সৌদি সশস্ত্রবাহিনী এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীর (National Guard) জন‍্য ঘাঁটি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সদর দপ্তর নির্মাণ করে।

১৯৬৯ সালে সৌদি আরবে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হলে, আদমশুমারিতে সৌদি আরবের জনসংখ‍্যার পরিমাণ দেখে তৎকালীন বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ (১৯৬৪-১৯৭৫) শঙ্কিত হন এবং সংখ‍্যাটি দ্বিগুণ করে প্রকাশ করেন, যাতে সৌদি আরবের জনতাত্ত্বিক দুর্বলতা বহির্বিশ্বের কাছে প্রকাশ না পায়। এর ফলে সৌদি আরবে পরবর্তীতে প্রকাশিত প্রতিটি আদমশুমারির ফলাফলই ছিল মিথ‍্যা। সৌদি সরকারের তথ‍্যমতে, ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের জনসংখ‍্যা ছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষের বেশি, যা ছিল সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকের জনসংখ্যার প্রায় সমান, এসময় ইরাকের জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লক্ষের কিছু বেশি।
কিন্তু সেসময়কার সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ‘জেনারেল ইন্টেলিজেন্স প্রেসিডেন্সি’র পরিচালক তুর্কি বিন ফয়সালের মতে, ঐসময় সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ লক্ষের কিছু বেশি! স্বাভাবিকভাবেই, জনসংখ্যা কমপক্ষে হওয়ায় সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদানের উপযুক্ত লোকের সংখ‍্যাও ছিল কম, ফলে সৌদি সশস্ত্রবাহিনী সংখ‍্যাগত দিক থেকে ছিল একদমই দুর্বল।
এই সংখ‍্যাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন‍্য সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ অর্থ ব‍্যয় করে এবং সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে। সৌদি আরবের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎস ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ‍্য, ফ্রান্স ও চীন। সৌদি আরব এই রাষ্ট্রগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অস্ত্রশস্ত্র কিনে।

১৯৮৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব যুক্তরাজ‍্যের সঙ্গে একটি বৃহৎ অস্ত্রচুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেটি ‘আল–ইয়ামামাহ অস্ত্র চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ‍্য সৌদি আরবকে ৯৬টি ‘টর্নেডো ইন্টারডিক্টর/স্ট্রাইকার’, ২৪টি ‘টর্নেডো এয়ার ডিফেন্স ভ‍্যারিয়ান্ট’, ৫০টি ‘বিএই হক’ এবং ৫০টি ‘পিলেটাস পিসি–৯’ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে। তদুপরি, যুক্তরাজ‍্য সৌদি আরবকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র ও বিশেষায়িত নৌযান সরবরাহ করে এবং সৌদি আরবে বিভিন্ন সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়। এটি ছিল যুক্তরাজ‍্যের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্র চুক্তি!

বস্তুত, ১৯৮০ এর দশকের শেষদিকে সৌদি সশস্ত্রবাহিনী প্রচুর পরিমাণ সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। সেই অনুযায়ী সৌদি আরবের সেসময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য থাকলেও কিন্তু সৌদি সশস্ত্রবাহিনীতে দুটি জিনিসের ঘাটতি ছিল, প্রশিক্ষণ এবং সৈন‍্যসংখ‍্যা যেটি দুর্বলতার কারণ হয়। জনসংখ্যা কম হওয়ায় সৌদি সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য সংখ্যা যথেষ্ট বড় ছিল না এবং সৈন‍্যদের প্রশিক্ষণের মান ছিল নিম্ন।

তবে সেসময় সৌদি আরবের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তখনো আসেনি। সৌদি আরবের উত্তরে জর্দান ও ইরাক, উত্তর পূর্বে কুয়েত, পূর্বে কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ পূর্বে ওমান এবং দক্ষিণে জনগণতান্ত্রিক ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র (দক্ষিণ ইয়েমেন) এবং ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়েমেন) অবস্থিত ছিল। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ‍্যে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দক্ষিণ ইয়েমেন ছাড়া অন‍্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক ভালো ছিল না, কিন্তু এই দরিদ্র দেশটির জনসংখ্যা ছিল সৌদি আরবের প্রকৃত জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ২৫ লক্ষ এবং তার কিছু বেশি। এবং দেশটির সৌদি আরবকে আক্রমণ করার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হয় এবং সৌদি রাষ্ট্রের প্রতি দক্ষিণ ইয়েমেন নিয়ে সৌদি আশঙ্কার আপাতত ইতি ঘটে।

একমাত্র সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকের সৌদি আরবকে আক্রমণ করার সামর্থ্য ছিল। সেসময় ইরাকের ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী, যারা ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরব‍্যাপী যুদ্ধে (১৯৮০-১৯৮৮) অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। ইরাকি সেনাবাহিনীতে ৫৩টি ডিভিশন এবং ২০টি স্পেশাল ফোর্স ব্রিগেড ছিল, এবং ইরাকি সেনাবাহিনীর মোট সদস‍্যসংখ‍্যা ছিল ৯,৫৫,০০০। এছাড়া ইরাকের ‘ইরাকি পপুলার আর্মি’, ‘রিপাবলিকান গার্ড’ ও ‘স্পেশাল রিপাবলিকান গার্ড’ আধা–সামরিক বাহিনী এবং আঞ্চলিক মিলিশিয়া বাহিনীগুলোতে ছিল আরো প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ সৈন্য। তদুপরি, ইরাকের ছিল ৫,৭০০টি ট‍্যাঙ্ক, ৩,০০০টি কামান, ৭০০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এবং একটি শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স বাহিনী। বিশেষত ইরাকের রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীতে ছিল মধ‍্যপ্রাচ‍্যের সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কয়েকটি ডিভিশন।

এবং সৌদি শাসকদের ইরাকি সামরিক সক্ষমতা এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য  সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল বলেই তারা ইরাকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আগেই যেমনটি বলেছিলাম সৌদি ইরান দ্বন্দ্ব এই দশকে নতুন নয়। সেসময় সৌদি আরব ইরাককে নয়, ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ইরানকে নিজেদের জন‍্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত। ইরাক–ইরান যুদ্ধ চলাকালে ইরাকের মূল অর্থনৈতিক মিত্র ছিল সৌদি আরব। এসময় রিয়াদ বাগদাদকে প্রায় ৩০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিল। ১৯৮৯ সালে সৌদি আরব ও ইরাক একটি পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অর্থাৎ, বাহ্যিকভাবে ইরাকের দিক থেকেও সৌদি আরবের প্রতি কোনো হুমকি ছিল না।

আর, ইরাকি রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেইন সৌদি আরবের জনসাধারণের মধ‍্যে বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন এই জন্য যে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে গলাবাজি করতে পারতেন ভালো আর মাইক্রোফোন কাপাতেন পশ্চিমা বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে। তার তীব্র ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব এবং পশ্চিমাবিদ্বেষী বক্তব‍্যগুলো আরব বিশ্বের বহু ধর্মভীরু মানুষ বিশেষভাবে পছন্দ করত। এর ফলে সাদ্দাম কখনো সৌদি আরব আক্রমণ করতে পারেন, এই আশঙ্কা সাউদির অল্প কিছু নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছাড়া সৌদি জনসাধারণের মনে ছিল না এবং ধারণার বাহিরে ছিল।

১৯৯০ দশকের শুরুতে ইরাক ও কুয়েতের মধ‍্যে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ইরাক ইরান যুদ্ধের সময় ইরাক কুয়েতের কাছ থেকে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেয় এবং যুদ্ধপরবর্তী ইরাকের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এই ঋণ মওকুফ করার জন্য ইরাক কুয়েতকে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু কুয়েত তাতে রাজি ছিল না; এবং ইরাকি কুয়েতি সীমান্তবর্তী তেলক্ষেত্রগুলোর মালিকানা নিয়ে দেশ দুটির মধ‍্যে বিরোধ দেখা দিলে ইরাক তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ জানালেও কুয়েত তাতে সম্মত হচ্ছিল না।

সৌদি আরব ইরাক ও কুয়েতের মধ‍্যে মধ‍্যস্থতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এবং চেষ্টা অব্যাহত রাখে, এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই স্বয়ং ইরাকি ও কুয়েতি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের মধ‍্যে একটি সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব‍্যর্থ হয়। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দামের সঙ্গে আলোচনায় এবং তাদের বিবৃতিতে ইঙ্গিত প্রদান করে যে, ইরাক ও কুয়েতের মধ‍্যে দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবে।

১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে বসে এবং দুই দিনের মধ‍্যে ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশটিকে দখল করে বসে সাদ্দাম আর এখান থেকেই শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির আগুন। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল ও সাদ্দামের লাগামহীন আচরণ সৌদি সরকারকে হতচকিত এবং আতঙ্কিত করে তোলে। বস্তুত সৌদি সরকার এতটাই হতবাক হয়ে পড়ে যে, সৌদি আরবের সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমকে এই খবর প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়। ইরাকের কুয়েত আক্রমণের এক সপ্তাহ পর সৌদি গণমাধ্যম এই খবরটি সম্প্রচার করে।
ইরাকের কুয়েত আক্রমণের ফলে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা একাকী সেটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েক দশক ধরে তারা আরব রাষ্ট্রগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সহায়তা প্রদান করেছিল তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। কিন্তু ইরাকের কুয়েত দখলের পর দেখা গেল যে, ইয়েমেন, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, সুদান, জর্দান এবং ফিলিস্তিন সহ এদের সকলেই ইরাককে সমর্থন করছে। কিন্তু আজকের মর্ডান সমালোচকরা কি আদো বুঝার চেষ্টা করেছি নিজেকে সেই অবস্থানে রেখে? “না” করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এত কিছু করার পরও কি সৌদি আরব চায়নি তাদের আরব ও মুসলিম রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রতাক না করুক? এত কিছু কি করার পরও কি সৌদি আরব চায়নি তাদের যেনো মুসলিম প্রতিবেশীদের দিকে অস্ত্রতাক করতে না হয়? এই প্রশ্নের উত্তর ফেসবুক ইউটিউব থেকে PHD করা আফ্রিকান আর ইন্দো-পাক-বেঙ্গল পোলাপান যারা দিন রাত আমাদের শাসক দের গালা গাল দিয়ে বেড়ায়। তাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া অসম্ভব এবং আশা করাটাও মূর্খতা।

অতঃপর: ইরাকের কুয়েত দখলের ফলে সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের দুঃস্বপ্ন যে বাস্তবে রূপ নিল। কুয়েতে মোতায়েনকৃত ইরাকি বাহিনী এবং সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে অবস্থিত তেলক্ষেত্রগুলোর মাজখানে কয়েক মাইল বালি ছাড়া আর কোনো বাধা ছিল না সৌদি আরবে ইরাকি সেনা প্রবেশের জন্য। সৌদি ন‍্যাশনাল গার্ডের একটি ব‍্যাটালিয়ন, এক হাজারেরও কম সংখ্যক সৈন‍্য তেলক্ষেত্রগুলো পাহারা দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় ইরাকি ট‍্যাঙ্কবহর যদি সৌদি সীমান্ত অতিক্রম করে সৌদি তেলক্ষেত্রগুলোর দিকে ধাবিত হতো, সৌদি আরবের পক্ষে সেসব সৌদি সাহসী সৈন্যদের লাশ কাধে নেওয়া ছাড়া কিছুই করা সম্ভব হতো না।

ইরাকি সামরিক বাহিনীর একটি ট্যাংক যেটি কুয়েতের সীমান্তজুড়ে ক্ষেত্রগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল।

সৌদি সশস্ত্রবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল, কিন্তু সেসময় তাদের সৈন‍্যসংখ‍্যা ছিল মাত্র ৫৮,০০০! এবং শুধু কুয়েতেই ইরাকি সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৭০,০০০ এরো বেশি তারা ইরাকি সৈন‍্যদের মতো সুপ্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ছিল না। এই শক্তি দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনীকে মোকাবেলা করা ছিল এক অসম্ভব ব‍্যাপার। সৌদি আরবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কাছে একটি পথই খোলা ছিল আর সেটিই হচ্ছে সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন‍্য মোতায়েন করা।

ইরাকি–কুয়েতি দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিতর্কিত। ইরাক কুয়েত দখল করে নেয়ার আগে মার্কিনীরা এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং তাদের এই অবস্থান ইরাককে কুয়েত আক্রমণ করতে উৎসাহিত করেছিল বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কিন্তু মার্কিনীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতি তেলভাণ্ডারের ওপর ইরাকের নিয়ন্ত্রণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ‍্যায়িত করে এবং কুয়েত থেকে ইরাককে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কূটনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ‍্যমে ইরাককে কুয়েত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ‍্য করতে ব‍্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এজন্য সৌদি আরবে সৈন‍্য মোতায়েন করতে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।

সৌদি রাজপরিবার সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। যুবরাজ ও ন‍্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন‍্য মোতায়েনের ঘোর বিরোধী ছিলেন, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, একবার সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করলে মার্কিনীরা আর কখনো সেখান থেকে সরবে না। অন‍্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নাইফের মতে, মার্কিন সহযোগিতা ছাড়া সম্ভাব‍্য ইরাকি আক্রমণ থেকে সৌদি আরবের রক্ষা পাওয়া অসম্ভব।

ইতোমধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনি এবং মধ‍্যপ্রাচ‍্যে নিয়োজিত মার্কিন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল নর্মান শোয়ার্জকফ একদল উপদেষ্টাসহ জেদ্দায় আসেন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের ব‍্যাপারে বাদশাহকে রাজি করানো। শোয়ার্জকফ সৌদি বাদশাহকে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কুয়েতে মোতায়েনকৃত ইরাকি বাহিনীর চিত্র দেখান। তার মতে, কুয়েতে ৩টি ইরাকি আর্মার্ড ডিভিশন এবং অতিরিক্ত পদাতিক সৈন্য অবস্থান করছিল। তিনি যুক্তি দেখান যে, কুয়েতের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র দখল করে রাখার জন‍্য এত সৈন্যসামন্তের প্রয়োজন নেই এবং ইরাক কুয়েতে এত সৈন্য মোতায়েন করেছে সৌদি আরবকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে।

সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাও এসময় জানায় যে, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইরাকি গোয়েন্দা দল সৌদি আরবের সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। এর ফলে ইরাক সৌদি আরব আক্রমণ করার জন‍্য তথ‍্য সংগ্রহ করছে, এই ধারণা সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের মধ‍্যে দৃঢ় হয়।

মার্কিন সৈন্যরা কখনোই সৌদি আরব ছেড়ে যাবে না, সৌদিদের এরকম আশঙ্কা দূর করার জন‍্য ডিক চেনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেন, ইরাকি হুমকির অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অথবা সৌদি বাদশাহ যখন চাইবেন তখনই মার্কিন সৈন্যদের সৌদি আরব থেকে প্রত‍্যাহার করে নেয়া হবে। মার্কিনীদের এই প্রতিশ্রুতির পর অবশেষে সৌদি বাদশাহ ফাহাদ সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের অনুমতি প্রদান করেন।

এসময় হাজার হাজার কুয়েতি শরণার্থী সৌদি আরবে এসে পৌঁছাচ্ছিল সেই সাথে ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিকও ছিল যাদের মধ্যে বড় একটি অংশই ছিল ভারত বর্ষের প্রবাসীরা যাদের সৌদি আরবে আশ্রয় দেওয়ার পর নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এবং কুয়েতি শরণার্থীদের, তাদের কাছে থেকে সৌদি জনসাধারণ কুয়েতে ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত খুন, লুণ্ঠন, অপহরণ ও নারী নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারে। তা সত্ত্বেও সৌদি জনসাধারণের একটি অংশ তাদের রাষ্ট্রে মার্কিন সৈন‍্য মোতায়েনের পক্ষপাতী ছিল না। সৌদি আরবে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থান মক্কা ও মদিনা অবস্থিত, এবং মুসলিমদের এই পবিত্র ভূমির সুরক্ষার জন‍্য অমুসলিমদের সহায়তা নিতে হবে, এই ধারণাটিই রক্ষণশীল সৌদি জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে।

সৌদি সরকার জনসাধারণের অসন্তোষ প্রশমিত করার জন‍্য সৌদি ধর্মীয় নেতাদের দ্বারস্থ হন বাদশা এবং সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের পক্ষে ফতোয়া দেয়ার নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী সৌদি ধর্মীয় নেতারা ফতোয়া জারি করেন যে, মার্কিন সৈন‍্যরা ‘মুসলিমদের রক্ষা এবং তাদের মুসলিমদের রক্ষার কাজেই নিয়োজিত করা হবে সেই জন‍্য সৌদি আরবে আসছে’ [এই বিষয়ে তৃতীয় পর্বে আলোচনা হবে]

অতঃপর: শুরু হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সৈন‍্যরা সৌদি আরবে আসতে শুরু করে এবং পাঁচ লক্ষাধিক মার্কিন সৈন‍্য সৌদি আরবে এসে পৌঁছে। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরবের সীমান্ত রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত হলেও ১৯৯১ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাদেরকে কুয়েতকে ইরাকি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য নিয়োজিত করা হবে এবং দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এবং ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’ পরিণত হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’–এ।

অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম এর সময় মার্কিন সেনারা।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকি সামরিক বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং কুয়েত থেকে ইরাকি সৈন‍্যদেরকে বিতাড়িত করে। পরে মার্কিন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সৌদি আরব থেকে মার্কিন প্রশাসন পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে আবার কিছু অল্প সংখ্যক সদস্যও মোতায়েন করা হয় প্রথমে ইরাকে ‘নো–ফ্লাই জোন’ কার্যকরী করার জন্য, পরবর্তীতে বিশ্বব‍্যাপী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র অংশ হিসেবে এবং বর্তমানে ইরানের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে।

বর্তমানে সৌদি আরবে কমপক্ষে ৫টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে যে বিপুল সংখ্যক মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে মোতায়েন করা হয়েছিল, ২০০৩ সালের মধ‍্যে তাদের সিংহভাগ প্রত‍্যাহার করে নেয়া হয়। বর্তমানে অল্প কিছু মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে মোতায়েন রয়েছে। তবে ২০১৯ সালে সৌদি তেলক্ষেত্রের ওপর আক্রমণের পর প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সৈন্য সেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেলের মূল্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ‍্যে বিরোধ দেখা দেয়ায় এদের অধিকাংশকে প্রত‍্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তবে ভবিষ্যতেও সৌদি আরব আঞ্চলিক শত্রু ইরানের মুকাবিলা করতে ইরাক-কুয়েত দ্বন্দ্বের সময়কার কৌশুল গ্রহণ করতে পারে। কারণ সৌদি আরব এখনো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও উন্নত মানের প্রশিক্ষনের ঘাটতি মেটাতে পারলেও সৈন্য সদস্য সংখ্যা এখনও আঞ্চলিক শত্রুদের চেয়েও তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে।

আগেই যেমনটি বলেছিলাম আজকের একদল কথিত শিক্ষিতদের দল যাদের উদ্দেশ্যই ছিল পানিকে দূষিত করে ফয়দা হাসিল করা তাদের মনগড়া তত্ব প্রসব করা যাদের কাজ আর তাদের লেজ ধরে বর্তমান প্রজন্মের একদল মর্ডান সমালোচকদের জন্ম হয়। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে ফেইসবুকে তিন চারটা অপশন টিপে মধ্যপ্রাচ্যের সমালোচনা আর গালা গালি মেতে উঠেন। কিন্তু এই সমালোচকরা শিক্ষিত বা অশিক্ষিত তারা কি কোনোদিনও তাদের জানা বিষয় গুলুতে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল? তারা কি এই নিয়ে পরা জানার প্রয়োজন বোধ করেছিল কি? তারা কি সেকালে ফিরে সত্য জানার চেষ্টা করেছিল কি? সোজাসাপটা উত্তর হবে “না” মমিনের সার্টিফিকেটের দাবিদাররা এসবের কিছুই প্রয়োজন মনে করেনি।

সেদিন যেভাবে আফ্রিকান অঞ্চলের আরব দেশগুলো সেই সঙ্গে আরাফাতের ফিলিস্তিন প্রতিবেশী জর্ডান এবং ইয়ামেন যেভাবে বেইমানি করেছিল আর আজ যদি ইরান সৌদিকে আক্রমণ করে তারা কি আসবেন সাউদির সাহায্যে? একদম কোনো সন্দেহ ছাড়াই উত্তর হবে “নিশ্চিত না” তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই কোনো না কোনো পন্থা বেছে নিতেই হবে। আত্মরক্ষার্থে।

[প্রথম পর্ব]

কিন্তু কেনইবা সৌদি আরব সেদিন অমুসলিম আমেরিকান বাহিনীদের আরব উপদ্বীপে প্রবেশ করতে দিয়েছিল?

উপসাগরীয় যুদ্ধ: জেনারেল সাদ্দামের কুয়েত দখল ও সৌদি ভূখণ্ডে মার্কিন সেনা ফ্যাক্ট: পর্ব ১

উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয় ২ আগস্ট, ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের মাধ্যমে এবং তা শেষ হয় ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে, যখন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ. ডাব্লিউ. বুশ আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। যুদ্ধের প্রক্কালে ইরাক কুয়েত দখল করলে কুয়েতের আমির প্রতিবেশী সৌদি আরবে আশ্রয় নেন।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের ওই পদক্ষেপকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে এবং সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অন্যান্য আরব দেশগুলো ইরাকি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়, তখন আরব লিগও এক প্রস্তাব পাশ করে ওই আহবানে সাড়া দেয়। এ সময় ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ অনুমোদিত বাহিনী দখলদার ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে এবং কুয়েতকে তাদের দখল মুক্ত করে।

যেহেতু আরব উপদ্বীপ ইসলামের পবিত্র একটি ভূমি হিসেবে পরিচিত তাই সে স্থানে দখলদার ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অমুসলিম খ্রিস্টান বাহিনীর সমাবেশকে মুসলমানদের একটি অংশ ইসলাম পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ কাজের জন্য তারা আরব ওয়ার্ল্ডের নেতৃত্ব দানকারী দেশ সৌদি আরব তথা সৌদ রাজ পরিবারকে দায়ী করে। বিশেষ করে জাজিরাতুল আরবে ধর্মীয় সংবেদনশীল যেকোনো বিষয়ে সৌদি সরকারের মতামতকে চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তাই সৌদির ওয়াশিংটনের কাছে সাহায্য চাওয়া, অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সৌদিকে অনুসরণ ও পরবর্তীতে সেখানে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের ঐ অংশটি আলে সৌদদের ইসলামের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে ব্যাপক “প্রপাগাণ্ডা” শুরু করে। তাদের প্রপাগাণ্ডার মূল বিষয় ছিল- বর্তমান সৌদি রাজপরিবারের দ্বারা ইসলাম এখন চরম সংকটে পড়ে গেছে, তারা আরব উপদ্বীপে ‘গায়ের মুসলিম’ বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ইসলামের সর্বাধিক পবিত্র স্থানগুলোর (মক্কা ও মদিনা) নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছে, সে স্থানের পবিত্রতা নষ্ট করেছে; কাজেই সৌদি সরকার এখন একটি অনৈসলামিক ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছে, যেটি কিনা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় আর সক্ষম নয়।

আলে সৌদদের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার শুরু করেন সৌদির ইখওয়ানি মুসলিমিন পন্থী আলেমরা, যারা সাইয়েদ কুতুবের আক্বীদা, দর্শন ও মানহাজের অনুসারী হওয়ায় তাদের “কুতুবী” বলা হয়। তারা তখন এই রাজপরিবার তথা পুরো সৌদি রাষ্ট্রের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তাদের প্রচারণা রীতিমতো একটি আন্দোলনের জন্ম দেয়, যেটাকে বলা হয় “সাহওয়া আন্দোলন”। এ আন্দোলন সৃষ্টির জনক ছিলেন শায়েখ সফর আল হাওয়ালি, যার প্রধান সহকারী বা প্রতিনিধি ছিলেন সালমান আওদা। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উপসাগরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরব উপদ্বীপে বিশেষ করে সৌদি আরবে খ্রিস্টান বাহিনীর উপস্থিতিকে ইসলামের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরা এবং সাধারণ মানুষের কাছে সৌদি সরকারের ইসলাম বিরোধী একটি ভাবমূর্তির সৃষ্টি করা। তাদের এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য সৌদি সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাদের মধ্যে সবচাইতে কুখ্যাত সৌদি বিরোধী প্রচারকারী ছিল আল-কায়েদার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন, তার প্রপাগান্ডা এতই চরম পর্যায়ে পৌছায় যে সৌদি সরকার তখন বাধ্য হয়েই তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু, সৌদি সরকার তখন কেবলমাত্র তাদের নির্বাহী ক্ষমতাবলে অমুসলিম খ্রিস্টান বাহিনীর কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেনি, বরং তাদের কাছে ছিল এর অনুমোদন দানকারী সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফতোয়া।

কিন্তু কেনইবা সৌদি আরব সেদিন অমুসলিম আমেরিকান বাহিনীদের আরব উপদ্বীপে প্রবেশ করতে দিয়েছিল?

সৌদির বাহিনী, বা আজ যারা ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রোপাগান্ডার ছড়াচ্ছেন আফ্রিকার অঞ্চলের পোলাপান আর এশিয়ান অঞ্চলের আধা মূর্খ পাবলিকরা বা বিন লাদেনের অনুসারী আফগান মুজাহেদিনরা কি দখলদার সাদ্দামকে শায়েস্তা করতে সক্ষম ছিল না? এর সোজাসাপটা জবাব “না”! সাদ্দামের সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির আধুনিক চৌকস আগ্রাসী বাহিনীকে প্রতিহত করা তখন সৌদি আরবের বাহিনী বা আফগানদের জংধরা পরিত্যক্ত অস্ত্রধারী মিলিশিয়াদের পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা। তখনকার সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকের সামরিক শক্তির দিকে তাকালেই তা সহজে বুঝা যায়। মুসলিম বিশ্বের কোনো শক্তির পক্ষেই তখন অস্ত্র দিয়ে সাদ্দামের মোকাবিলা করা ছিল অসম্ভব, যেটা সৌদির শাসকরা ঠিক বুঝতে পারলেও ক্ষমতার বাইরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলগুলো তা বুঝতে পারে নি বা বুঝতে পারলেও সেটাকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফায়দা লুটার ফন্দি করেছিল। যদি কেবল সৌদির বাহিনী সাদ্দামকে রুখার চেষ্টা করতো তাহলে সাদ্দাম পুরো আরব উপদ্বীপকে করতলগত করে সেখান থেকে শরীয়া শাসনকে উচ্ছেদ করত, বিশেষ করে সৌদি আরবের কুরআনের শাসনকে সে রদ করে বা কোরআনের শাসনকে আরো আধুনিক করার নামে তার বামপন্থী শাসনগুলু কায়েম  করত; সেখানে সাদ্দামের ধর্মের নামে অধর্মের কার্যকলাপ বিশেষ করে মক্কা-মদিনায় (যে ভাবে ইরাকে তখন সেগুলো চালু ছিল); রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফেরাউনের মত সাদ্দাম তার মূর্তি স্থাপন করতো ইত্যাদি সাদ্দামের বহু অনৈসলামিক কর্মের দৃষ্টান্ত তখন আলে সৌদ সহ অন্যান্য আরব নেতৃবৃন্দের সামনে ছিল। তাছাড়া আরব উপদ্বীপে আরো কত বড় ফিতনা যে সৃষ্টি হত তা অনুমেয় ছিল (যদি সেটা ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে অনুমান করার চেষ্টা)। আর বিন লাদেনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সৌদি সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য কব্জা করে নিত আফগান ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী, ইরাকি বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষে সে দিন তখন পুরো জাজিরাতুল আরব এক জাহান্নামে পরিণত হত। সৌদি সরকারের কাছে সে হিসাব সেদিন ছিল।

২ আগস্ট ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের পর আরব লীগের বেশ কয়েকটি মিটিংয়ে একাধিক রেজুলেশন পাশ করা হয়। সেখানে ইরাকের কুয়েত দখলের নিন্দা করার পাশাপাশি কুয়েত থেকে দখলদার বাহিনীকে প্রত্যাহারের জোর দাবি জানানো হয়; এমন কি ইরাকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত এরাবিয়ান বাহিনী ঘটন করে সৌদি ও কুয়েতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যদিও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে গাদ্দাফির লিবিয়া ও আরাফাতের পিএলও (ফিলিস্তিন) সহ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান অঞ্চলের আরব দেশগুলি সেদিন সৌদি-কুয়েত জোটকে সমর্থন না করে ইরাককে সমর্থন করে। অথচ সৌদি আরব সেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে বছরের-পর-বছর বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে আসছিল। কিন্তু তারাও যে বেইমানি করবে সেটা হয়তো বাদশা আশঙ্কা করেছিলেন কিন্তু আশা করেননি। অতঃপর দুঃখের হলেও সত্য সেই আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নেয়।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে একটি প্রস্তাব পাস করে, ঐ প্রস্তাবে কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করার জন্য বল প্রয়োগ করাকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বৈরাচার সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে আরব সরকারগুলোর একটি জোট গড়ে ওঠে মার্কিন সরকারের নেতৃত্বে, যেটাকে অনুমোদন দেন তৎকালীন সৌদি বাদশা ফাহাদ (রাহি:)। ফলে ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ কোয়ালিশন বাহিনী দখলদার ইরাককে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করে এবং কুয়েতকে তার দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করে। উপসাগরীয় যুদ্ধে যারা মার্কিনীদের অংশগ্রহণকে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিলেন, তার আজ প্রায় ৩০ বছর পর সৌদিতে ইসলাম কতটুকু ধ্বংস হয়েছে আর কতটুকু কায়েম রয়েছে এবং মক্কা মদিনার নিরাপত্তা কতটুকুই বা বিঘ্ন ঘটেছে তা তাদের বিবেকের আদালতে বিচার করার জন্য পেশ করা হলো। আর তাদের সে বিপরীত প্রস্তাব মেনে নিলে দুনিয়ার বুকে সে আরব রাষ্ট্রের আদৌ কোনো অস্তিত্ব থাকতো কিনা সেটাও যেন তারা চিন্তা করে দেখেন। আমি শুধু বলবো সৌদি আরব আমেরিকানদের মিলিটারি বেস করতে দেয়ার জন্য আফ্রিকান ও এদেশের ফকিন্নির যে পোলাপাইন দিনরাত তাকে খিস্তি করে চলে সৌদির বিপদের সময় তাদের বাপদাদা চোদ্দগুষ্টিকে বিক্রি করে দিলেও কি সৌদি আরবের কোনো সাহায্যে তারা আদৌ আসতে পারবে বা পারতো?

[দ্বিতীয় পর্ব]