কিন্তু কেনইবা সৌদি আরব সেদিন অমুসলিম আমেরিকান বাহিনীদের আরব উপদ্বীপে প্রবেশ করতে দিয়েছিল?

উপসাগরীয় যুদ্ধ: জেনারেল সাদ্দামের কুয়েত দখল ও সৌদি ভূখণ্ডে মার্কিন সেনা ফ্যাক্ট: পর্ব ১

উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয় ২ আগস্ট, ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের মাধ্যমে এবং তা শেষ হয় ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে, যখন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ. ডাব্লিউ. বুশ আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। যুদ্ধের প্রক্কালে ইরাক কুয়েত দখল করলে কুয়েতের আমির প্রতিবেশী সৌদি আরবে আশ্রয় নেন।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের ওই পদক্ষেপকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে এবং সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অন্যান্য আরব দেশগুলো ইরাকি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়, তখন আরব লিগও এক প্রস্তাব পাশ করে ওই আহবানে সাড়া দেয়। এ সময় ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ অনুমোদিত বাহিনী দখলদার ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে এবং কুয়েতকে তাদের দখল মুক্ত করে।

যেহেতু আরব উপদ্বীপ ইসলামের পবিত্র একটি ভূমি হিসেবে পরিচিত তাই সে স্থানে দখলদার ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অমুসলিম খ্রিস্টান বাহিনীর সমাবেশকে মুসলমানদের একটি অংশ ইসলাম পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ কাজের জন্য তারা আরব ওয়ার্ল্ডের নেতৃত্ব দানকারী দেশ সৌদি আরব তথা সৌদ রাজ পরিবারকে দায়ী করে। বিশেষ করে জাজিরাতুল আরবে ধর্মীয় সংবেদনশীল যেকোনো বিষয়ে সৌদি সরকারের মতামতকে চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তাই সৌদির ওয়াশিংটনের কাছে সাহায্য চাওয়া, অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সৌদিকে অনুসরণ ও পরবর্তীতে সেখানে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের ঐ অংশটি আলে সৌদদের ইসলামের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে ব্যাপক “প্রপাগাণ্ডা” শুরু করে। তাদের প্রপাগাণ্ডার মূল বিষয় ছিল- বর্তমান সৌদি রাজপরিবারের দ্বারা ইসলাম এখন চরম সংকটে পড়ে গেছে, তারা আরব উপদ্বীপে ‘গায়ের মুসলিম’ বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ইসলামের সর্বাধিক পবিত্র স্থানগুলোর (মক্কা ও মদিনা) নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছে, সে স্থানের পবিত্রতা নষ্ট করেছে; কাজেই সৌদি সরকার এখন একটি অনৈসলামিক ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছে, যেটি কিনা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় আর সক্ষম নয়।

আলে সৌদদের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার শুরু করেন সৌদির ইখওয়ানি মুসলিমিন পন্থী আলেমরা, যারা সাইয়েদ কুতুবের আক্বীদা, দর্শন ও মানহাজের অনুসারী হওয়ায় তাদের “কুতুবী” বলা হয়। তারা তখন এই রাজপরিবার তথা পুরো সৌদি রাষ্ট্রের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তাদের প্রচারণা রীতিমতো একটি আন্দোলনের জন্ম দেয়, যেটাকে বলা হয় “সাহওয়া আন্দোলন”। এ আন্দোলন সৃষ্টির জনক ছিলেন শায়েখ সফর আল হাওয়ালি, যার প্রধান সহকারী বা প্রতিনিধি ছিলেন সালমান আওদা। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উপসাগরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরব উপদ্বীপে বিশেষ করে সৌদি আরবে খ্রিস্টান বাহিনীর উপস্থিতিকে ইসলামের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরা এবং সাধারণ মানুষের কাছে সৌদি সরকারের ইসলাম বিরোধী একটি ভাবমূর্তির সৃষ্টি করা। তাদের এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য সৌদি সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাদের মধ্যে সবচাইতে কুখ্যাত সৌদি বিরোধী প্রচারকারী ছিল আল-কায়েদার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন, তার প্রপাগান্ডা এতই চরম পর্যায়ে পৌছায় যে সৌদি সরকার তখন বাধ্য হয়েই তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু, সৌদি সরকার তখন কেবলমাত্র তাদের নির্বাহী ক্ষমতাবলে অমুসলিম খ্রিস্টান বাহিনীর কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেনি, বরং তাদের কাছে ছিল এর অনুমোদন দানকারী সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফতোয়া।

কিন্তু কেনইবা সৌদি আরব সেদিন অমুসলিম আমেরিকান বাহিনীদের আরব উপদ্বীপে প্রবেশ করতে দিয়েছিল?

সৌদির বাহিনী, বা আজ যারা ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রোপাগান্ডার ছড়াচ্ছেন আফ্রিকার অঞ্চলের পোলাপান আর এশিয়ান অঞ্চলের আধা মূর্খ পাবলিকরা বা বিন লাদেনের অনুসারী আফগান মুজাহেদিনরা কি দখলদার সাদ্দামকে শায়েস্তা করতে সক্ষম ছিল না? এর সোজাসাপটা জবাব “না”! সাদ্দামের সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির আধুনিক চৌকস আগ্রাসী বাহিনীকে প্রতিহত করা তখন সৌদি আরবের বাহিনী বা আফগানদের জংধরা পরিত্যক্ত অস্ত্রধারী মিলিশিয়াদের পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা। তখনকার সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকের সামরিক শক্তির দিকে তাকালেই তা সহজে বুঝা যায়। মুসলিম বিশ্বের কোনো শক্তির পক্ষেই তখন অস্ত্র দিয়ে সাদ্দামের মোকাবিলা করা ছিল অসম্ভব, যেটা সৌদির শাসকরা ঠিক বুঝতে পারলেও ক্ষমতার বাইরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলগুলো তা বুঝতে পারে নি বা বুঝতে পারলেও সেটাকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফায়দা লুটার ফন্দি করেছিল। যদি কেবল সৌদির বাহিনী সাদ্দামকে রুখার চেষ্টা করতো তাহলে সাদ্দাম পুরো আরব উপদ্বীপকে করতলগত করে সেখান থেকে শরীয়া শাসনকে উচ্ছেদ করত, বিশেষ করে সৌদি আরবের কুরআনের শাসনকে সে রদ করে বা কোরআনের শাসনকে আরো আধুনিক করার নামে তার বামপন্থী শাসনগুলু কায়েম  করত; সেখানে সাদ্দামের ধর্মের নামে অধর্মের কার্যকলাপ বিশেষ করে মক্কা-মদিনায় (যে ভাবে ইরাকে তখন সেগুলো চালু ছিল); রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফেরাউনের মত সাদ্দাম তার মূর্তি স্থাপন করতো ইত্যাদি সাদ্দামের বহু অনৈসলামিক কর্মের দৃষ্টান্ত তখন আলে সৌদ সহ অন্যান্য আরব নেতৃবৃন্দের সামনে ছিল। তাছাড়া আরব উপদ্বীপে আরো কত বড় ফিতনা যে সৃষ্টি হত তা অনুমেয় ছিল (যদি সেটা ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে অনুমান করার চেষ্টা)। আর বিন লাদেনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সৌদি সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য কব্জা করে নিত আফগান ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী, ইরাকি বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষে সে দিন তখন পুরো জাজিরাতুল আরব এক জাহান্নামে পরিণত হত। সৌদি সরকারের কাছে সে হিসাব সেদিন ছিল।

২ আগস্ট ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের পর আরব লীগের বেশ কয়েকটি মিটিংয়ে একাধিক রেজুলেশন পাশ করা হয়। সেখানে ইরাকের কুয়েত দখলের নিন্দা করার পাশাপাশি কুয়েত থেকে দখলদার বাহিনীকে প্রত্যাহারের জোর দাবি জানানো হয়; এমন কি ইরাকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত এরাবিয়ান বাহিনী ঘটন করে সৌদি ও কুয়েতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যদিও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে গাদ্দাফির লিবিয়া ও আরাফাতের পিএলও (ফিলিস্তিন) সহ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান অঞ্চলের আরব দেশগুলি সেদিন সৌদি-কুয়েত জোটকে সমর্থন না করে ইরাককে সমর্থন করে। অথচ সৌদি আরব সেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে বছরের-পর-বছর বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে আসছিল। কিন্তু তারাও যে বেইমানি করবে সেটা হয়তো বাদশা আশঙ্কা করেছিলেন কিন্তু আশা করেননি। অতঃপর দুঃখের হলেও সত্য সেই আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নেয়।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে একটি প্রস্তাব পাস করে, ঐ প্রস্তাবে কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করার জন্য বল প্রয়োগ করাকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বৈরাচার সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে আরব সরকারগুলোর একটি জোট গড়ে ওঠে মার্কিন সরকারের নেতৃত্বে, যেটাকে অনুমোদন দেন তৎকালীন সৌদি বাদশা ফাহাদ (রাহি:)। ফলে ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ কোয়ালিশন বাহিনী দখলদার ইরাককে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করে এবং কুয়েতকে তার দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করে। উপসাগরীয় যুদ্ধে যারা মার্কিনীদের অংশগ্রহণকে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিলেন, তার আজ প্রায় ৩০ বছর পর সৌদিতে ইসলাম কতটুকু ধ্বংস হয়েছে আর কতটুকু কায়েম রয়েছে এবং মক্কা মদিনার নিরাপত্তা কতটুকুই বা বিঘ্ন ঘটেছে তা তাদের বিবেকের আদালতে বিচার করার জন্য পেশ করা হলো। আর তাদের সে বিপরীত প্রস্তাব মেনে নিলে দুনিয়ার বুকে সে আরব রাষ্ট্রের আদৌ কোনো অস্তিত্ব থাকতো কিনা সেটাও যেন তারা চিন্তা করে দেখেন। আমি শুধু বলবো সৌদি আরব আমেরিকানদের মিলিটারি বেস করতে দেয়ার জন্য আফ্রিকান ও এদেশের ফকিন্নির যে পোলাপাইন দিনরাত তাকে খিস্তি করে চলে সৌদির বিপদের সময় তাদের বাপদাদা চোদ্দগুষ্টিকে বিক্রি করে দিলেও কি সৌদি আরবের কোনো সাহায্যে তারা আদৌ আসতে পারবে বা পারতো?

[দ্বিতীয় পর্ব]

Leave a comment